সংকটের অজুহাতে প্রতিদিনই বাড়ছে দাম
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে ডিমের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি, অথচ বাজারে ডিমের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলছে। বাংলাদেশে বছরে ২ হাজার ৩৭৪ কোটি ৯৭ লাখ পিস ডিম উৎপাদিত হয়, যেখানে চাহিদা ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৬০ লাখ পিস। এই হিসাব অনুযায়ী দেশে বছরে ৫৬৫ কোটি ৩৭ লাখ পিস ডিম উদ্বৃত্ত থাকার কথা। তবে বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। সাধারণ ভোক্তারা উচ্চ মূল্যে ডিম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন, যা নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে।
ডিমের দামের উল্লম্ফন
বর্তমানে বাজারে প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা, যেখানে সপ্তাহখানেক আগেও তা ছিল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ফার্মের ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে ৫৮-৬০ টাকায়, যেখানে সরকারের নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্য ৪৮ টাকা। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষ আর খামারিরা বিপাকে পড়েছেন।
বাজার সিন্ডিকেটের শিকার
প্রান্তিক খামারিরা অভিযোগ করছেন, দেশের পোলট্রি শিল্পের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে করপোরেট কোম্পানিগুলো। এসব কোম্পানি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার জানান, “দেশে দৈনিক চাহিদা চার কোটি পিস ডিম হলেও, উৎপাদন হচ্ছে প্রায় সাড়ে চার কোটি পিস। কিন্তু তেজগাঁওয়ের কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে চলেছে। ডিমের পাশাপাশি মুরগির ফিড ও একদিনের মুরগির বাচ্চার দামও তারা নিয়ন্ত্রণ করছে, যা খামারিদের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে।”
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির বক্তব্য
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি অবশ্য সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ বলেন, “আমরা সারাদেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করি না, বরং আমাদের তেজগাঁও থেকে দৈনিক মাত্র ১৪-১৫ লাখ পিস ডিম সরবরাহ করা হয়। বৃষ্টির কারণে ডিমের সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে এবং এজন্য দাম বাড়ছে। তবে শীতের সবজি বাজারে এলে ডিমের দাম স্বাভাবিক হবে বলে আমরা আশা করি।”
অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশে পর্যাপ্ত ডিম উৎপাদন হলেও বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে সাধারণ মানুষ সেই সুবিধা পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. বাপন দে বলেন, “প্রতি পিস ডিমের ওপর ৩-৪ টাকা অতিরিক্ত নেয়া হচ্ছে, কারণ সরবরাহ চেইনে একাধিকবার দাম বাড়ছে। সরকার যদি বাজার ব্যবস্থাপনায় কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করতে পারে, তাহলে এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব হবে।”
বন্যার প্রভাব ও বাজারের অস্থিরতা
ব্যবসায়ীরা সাম্প্রতিক বন্যাকে দামের অস্থিরতার কারণ হিসেবে দেখালেও, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর এক গবেষণায় জানা গেছে যে, বন্যায় দেশের পোলট্রি খাতের ক্ষতি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। তবে বাজারের বড় করপোরেট কোম্পানির সিন্ডিকেট মূল কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
সরকারি উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রণের অভাব
বাজারের এই অস্বাভাবিকতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের যথাযথ মনিটরিং প্রয়োজন। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম জানান, “চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজার মনিটরিং করে দেখা হচ্ছে কেন দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেও একটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে, যারা বাজারে সরাসরি নজরদারি চালাবে।”
সাধারণ ভোক্তার জন্য সংকট
বর্তমান বাজার পরিস্থিতি সাধারণ ভোক্তাদের জন্য বড় চাপ তৈরি করেছে। ডিম, যা সাধারণ মানুষের আমিষের অন্যতম উৎস, এখন অনেকের জন্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রতিদিন ডিমের দাম বৃদ্ধির ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যতালিকায় বড় প্রভাব পড়ছে।
সংক্ষেপে সিদ্ধান্ত:
ডিমের বাজারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে এবং সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ এবং বাজার ব্যবস্থাপনার সংস্কার প্রয়োজন। বড় করপোরেট কোম্পানির সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে, বাজারের এই অস্থিরতা কাটানো কঠিন হবে।