বাংলাদেশের ইতিহাসে সংস্কার উদ্যোগের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, সংবিধান, জনপ্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন—দেশের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ খাতে পরিবর্তনের লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো শীঘ্রই তাদের কার্যক্রম শুরু করবে। ইতোমধ্যে কমিশনগুলোর প্রধানদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, এবং শীঘ্রই প্রজ্ঞাপন জারি করে কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আজ-কালকের মধ্যেই এই প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বার্তা: আলোচনার গুরুত্ব
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, কমিশনগুলো পুরোদমে কাজ শুরু করার আগে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরেক দফা আলোচনা করতে চায়। তিনি উল্লেখ করেছেন, “এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, কমিশনের কাজ শুরুর আগে আমরা সব রাজনৈতিক দলের মতামত সংগ্রহ করবো। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো এই প্রক্রিয়ার একটি অংশ, তাই তাদের অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য।” শিগগিরই এই আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
ছয়টি কমিশনের প্রধান ও তাদের দায়িত্ব
প্রধান উপদেষ্টার ১১ সেপ্টেম্বরের জাতির উদ্দেশে ভাষণে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা করা হয়। প্রতিটি খাতে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
• নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন: বদিউল আলম মজুমদার
• পুলিশ সংস্কার কমিশন: সফর রাজ হোসেন
• বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন: বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান
• দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন: ইফতেখারুজ্জামান
• জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন: আবদুল মূয়ীদ চৌধুরী
• সংবিধান সংস্কার কমিশন: অধ্যাপক আলী রীয়াজ
এছাড়া, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কমিশনগুলোর কাজ শেষ হওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। তবে সরকার প্রাথমিকভাবে জনগণের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে বলে জানিয়েছে।
সংস্কারের উদ্দেশ্য এবং সময়সীমা
এই সংস্কারগুলোর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। কমিশনগুলোর কার্যক্রম দেশের সুশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর ও স্বচ্ছ করার দিকে গুরুত্ব দেবে। এর ফলে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দক্ষতা নিশ্চিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী, কমিশনগুলোর কাজ ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ করতে হবে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে, এবং এরপরই সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সুপারিশগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে। সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শও করা হবে, যেখানে সমাজের সব পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
কমিশনের কাজের স্থান ও প্রস্তুতি
সংস্কার কমিশনগুলোর অফিসের প্রস্তুতি নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রতিটি মন্ত্রণালয় নিজ নিজ কমিশনের জন্য অফিস স্থান নির্ধারণ করছে। উদাহরণস্বরূপ, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের অফিস জাতীয় সংসদের এমপি হোস্টেলের ১ নম্বর ব্লকে স্থাপন করা হয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের জন্য সচিবালয়ে প্রাক্তন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরটি নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেখানে ইতিমধ্যেই কমিশনের প্রধান আবদুল মূয়ীদ চৌধুরীর নামফলক স্থাপন করা হয়েছে।
নির্বাচনের ভবিষ্যৎ: সময়সীমার ওপর নির্ভরশীল
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, “নির্বাচনের সময়সূচি নির্ভর করছে কমিশনের প্রতিবেদনের উপর এবং তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার ফলাফলের ওপর।” শফিকুল আলম আরও বলেন, সেনাপ্রধানের মন্তব্যকে বোঝাতে গিয়ে বলেছেন যে, নির্বাচন কবে হবে তা এখনই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তবে কমিশনের কাজ শেষ হওয়ার পরই সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টি
এই সংস্কার প্রক্রিয়ার দিকে আন্তর্জাতিক মহলেরও বিশেষ নজর রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই কমিশনগুলোর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছেও সমাদৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এই উদ্যোগকে সমর্থন জানাচ্ছে এবং সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য সহযোগিতার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
সংস্কার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ ফলাফল
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি এই ছয়টি কমিশন সঠিকভাবে কাজ করতে পারে, তবে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসন এবং বিচার বিভাগে এক নতুন যুগের সূচনা হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। এই সংস্কারের ফলে শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে বলে আশাবাদী সবাই।
প্রশ্ন রয়ে গেল: এই সংস্কার প্রক্রিয়া কি সত্যিই বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে?