শ্রীলঙ্কার পথে পথে: ময়ূরের মাঝে পদব্রজে অভিযাত্রা

বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী, যিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট এবং লোৎসে জয় করেছেন, এবার নতুন এক ভ্রমণে নেমেছেন। শ্রীলঙ্কার উত্তর বিন্দু ‘পয়েন্ট পেড্রো’ থেকে দক্ষিণের ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’ পর্যন্ত প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার হাঁটার যাত্রা শুরু করেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন জুমন নিয়াজ। এই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন বাবর আলী, যা প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম আলোতে। আজ সেই যাত্রার দ্বাদশ পর্বের বিবরণে আমরা চলব তাঁর সঙ্গে পথে পথে।

দিন শুরু: মহিয়ানগানায়ার শীতল সকাল

সকাল শুরু হলো মহিয়ানগানায়া শহরের পথঘাটে ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলের শুভ্রতায়। এই ফুল শরতের আগমনী বার্তা, যা দুর্গাপূজার আগমনকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। মহিয়ানগানায়া ন্যাশনাল স্কুলের সামনে শিক্ষার্থীদের ভিড়, অভিভাবকদের চলাফেরা—সব মিলিয়ে শহরের সকাল যেন উৎসবমুখর। এরপর পথ চলে মহিয়ানগানায়া রাজমহা বিহারের দিকে। মহাওয়েলি গঙ্গার ধীর গতিতে বয়ে চলা নদীর পাশ দিয়ে এগিয়ে চলছি। রাজমহা বিহারের বৌদ্ধমূর্তি আর বিশাল বোধিদ্রুমের ছায়া যেন শ্রান্ত পথিকের জন্য প্রশান্তির আশ্রয়।

ময়ূরের শহরে

আজকের পথচলায় সবচেয়ে চোখে পড়েছে ময়ূর। আমাদের দেশে কাক যত, শ্রীলঙ্কায় ময়ূরের সংখ্যা তেমনই মনে হয়। ময়ূরের ডাক শুনে তাকালেই একটির দেখা মেলে। তবে তাদের ডাক শুনতে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছি, যেন তারা এই যাত্রার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। একের পর এক ময়ূর দেখে মনে হয়, এ যেন ময়ূরের রাজ্য! সি-৬০২ নম্বর রাস্তার নামকরণ করলেই সেটি ‘ময়ূর সড়ক’ হতে পারে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে হাঁটাহাঁটি

রাস্তার ধারে ব্রেডফ্রুটগাছ আর বিশাল সব কাঠগোলাপের গাছ পথের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। পথে ছোট্ট একটি দোকানে নাশতা সারতে বসলাম। বাবর আলীর শাকাহারী খাবারের প্রতি ঝোঁক থাকলেও জুমন নিয়াজ মাংসপ্রেমী। এক মুসলিম দোকানে মাংস পেয়ে তিনি তা তৃপ্তির সাথে উপভোগ করলেন।

মাপাকাদাওয়েয়া নামক জনপদে মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা, যেখানে স্থানীয়রা আমাদের দেখলে বারবার থামিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করছিল। সিংহলি শব্দ ‘আবিদিনেবা’, যার অর্থ হাঁটা, তা উচ্চারণ করেই আমরা তাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলাম। পথে দেখা পেলাম পাংরাগাম্মানাতে একটি মুসলিম বিদ্যালয়ের এবং শিশুদের উচ্ছলতায় ভরা ক্রিকেট খেলার।

পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য

এরপরের পথচলায় যেন প্রকৃতির সৌন্দর্য আমাদের আরও কাছে টেনে নিল। লোজ্ঞাল ওয়ায় প্রাকৃতিক হ্রদের জলরাশি পাহাড়ের ছায়া প্রতিফলিত করছে। এই দৃশ্য যেন ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে উঠে এসেছে। পাহাড়ি বাঁক ধরে চলতে চলতে আমরা পৌঁছালাম রাজামাওয়াথা জংশনে, যেখানে চায়ের বিশ্রাম নিলাম।

দিনশেষে ধুন্দলের স্বাদ

পাহাড়ের রাস্তা ধরে আরও কিছু দূর এগিয়ে পড়ল মিগাহাকিউলা জনপদ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩২৭ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই ছোট্ট শহরটি শান্ত ও ছিমছাম। এখানকার এক দোকানে দুপুরের খাবার খেলাম—শ্রীলঙ্কার অন্যতম সেরা ভেজ মিল। ধুন্দল আর পেঁয়াজ ভাজার স্বাদ মনে থাকবে দীর্ঘদিন।

শেষ মাথায় বিশাল সব চড়াই ভেঙে আমরা এগিয়ে চললাম। পাহাড়ি পথে সঙ্গী হলো বাদুলু ওয়া নদী। রাস্তার পাশে ধাপে ধাপে চাষ করা ফসল যেন পাহাড়ের কোলে ঝুলন্ত খেতের মতো। দিনের শেষ জংশন থাল্ডেনায় এসে আমরা আজকের যাত্রা শেষ করলাম।