দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলো প্রায় সবসময়ই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ আইন অনুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতে শতাধিক চুক্তি সম্পাদিত হয়, যার বেশিরভাগই ছিল বিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কিত। এই চুক্তি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে যদিও কাগজে-কলমে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) কাজ পরিচালনা করতো, মূলত সব সিদ্ধান্তই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই নিয়ন্ত্রণ হতো।
ক্ষমতায় থাকার দীর্ঘ ১৫ বছর পর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনোই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় অন্য কারও হাতে তুলে দেননি। চারবার সরকার গঠনের পরেও, প্রতিবারই অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের বণ্টন হলেও, তিনি এই মন্ত্রণালয়টি নিজের কাছে রেখেছিলেন। এতে বৃহৎ প্রকল্পগুলো যেমন আদানি, রামপাল, মাতারবাড়ি, এর মতো প্রকল্পগুলোর অনুমোদন একচেটিয়া ভাবে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে গৃহীত হয়। তবে, এই চুক্তি ও প্রকল্পগুলো নিয়ে জনসাধারণকে কোনো তথ্য জানানো হয়নি, যা অনেকের কাছে প্রশ্ন উঠিয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে এই বিশেষ পরিচালনা ব্যবস্থার ফলে, বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “বৃহৎ প্রকল্পের পেছনে বিপুল অর্থ চলে যেত, যা সরকার ও পছন্দের কোম্পানির মাঝে ভাগ হয়ে যেত।” এর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ খাত থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত সেই ঘাটতি ভোক্তাদের উপর বিদ্যুৎ বিলের মাধ্যমে চাপানো হয়েছিল।
বিদ্যুৎ খাতের সাবেক কর্মকর্তা বিডি রহমত উল্লাহ জানান, “এ খাতের প্রকল্পগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়া ছিল চ্যালেঞ্জিং, কারণ এখানে বড় অঙ্কের অর্থ জড়িত। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নানা চাপ আসতো, ফলে প্রকল্পগুলো অনুমোদন করার জন্য সঠিক নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি।”
এ বিষয়ে বিএনপি দলের পক্ষ থেকে, বিদ্যুৎ খাতে হওয়া চুক্তিগুলো পুনরায় পর্যালোচনা করার এবং সেগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করার দাবি জানানো হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, “বিদ্যুৎ খাতে যা হয়েছে, তা জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। চুরি, দুর্নীতি এবং কমিশন বাণিজ্য এই খাতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
ভবিষ্যতে, বিদ্যুৎ খাতের আরও কার্যকর এবং দক্ষ পরিচালনার জন্য বিএনপি নেতারা উল্লেখ করেছেন যে, সরকার এই খাতে প্রযুক্তিগতভাবে অভিজ্ঞদের নিয়োগ দিতে পারে। তবে, অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, শুধু দক্ষতা নয়, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে জনগণের জন্য সাশ্রয়ী এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।
বিদ্যুৎ খাতের মন্ত্রণালয় যে প্রধানমন্ত্রীর হাতে এত দীর্ঘ সময় ছিল, তা প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে বিশেষ অবস্থান তৈরি করে। ভারতের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, নেপালের জ্বালানি মন্ত্রণালয়, ভুটানের এবং পাকিস্তানের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে না থাকলেও, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বরাবরই প্রধানমন্ত্রীর কাছেই ছিল, যা ভবিষ্যতে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।
এখন, বিদ্যুৎ খাতের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসবে কি না, তা দেখার বিষয়। সরকারের ভবিষ্যত পদক্ষেপের উপর নির্ভর করে এই খাতের উন্নয়ন এবং জনগণের উপকারিতা নিশ্চিত হবে, এমন আশা রাখেন বিশেষজ্ঞরা।