দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো গতকাল শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে নির্বাচনের গুরুত্বকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছে। তারা বিশেষ করে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রকাশের দাবি জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচন কমিশন গঠন এবং সংস্কার—সবকিছু একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করা হবে, যাতে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হয়।
সংলাপের সূচনা
নবগঠিত সংস্কার কমিশন ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রথম দিনে বেলা আড়াইটায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। এরপর একে একে জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি এবং গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে সংলাপ হয়।
বিএনপির দাবির মূল সারমর্ম
বিএনপির প্রতিনিধিদল প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠকে অংশগ্রহণ করে। বৈঠক শেষে দলের প্রধান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আলোচনার প্রধান বিষয় নির্বাচন। আমরা কবে নাগাদ নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে একটি রোডম্যাপ দিতে বলেছি।’ বিএনপির ১৮টি মূল দাবি ছিল—নির্বাচন কমিশন সংস্কারে বিতর্কিত ব্যক্তিদের অব্যাহতি, জাতীয় পরিচয়পত্রের আইন বাতিল, ফ্যাসিবাদের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকদের অপসারণ এবং জেলা প্রশাসক নিয়োগে নতুন ফিটলিস্ট তৈরির দাবি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি
সংলাপ শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার কাজের পাশাপাশি নির্বাচনের কার্যক্রমও এগিয়ে নেবেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছয়টি কমিশন রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কথা বলবে। তিন মাসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন দেবে এবং সেই প্রতিবেদন নিয়ে পুনরায় আলোচনায় বসবে।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবনা
সংলাপে জামায়াতে ইসলামী দুটি রোডম্যাপ দাবি করেছে—একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার এবং অন্যটি নির্বাচনের। তারা মনে করে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘সব সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার করুক, এটি আমরা চাই না। তাহলে নির্বাচিত সরকার কী করবে?’
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা জোনায়েদ সাকি প্রস্তাব করেছেন, রাজনৈতিক দল ও ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি জাতীয় রাজনৈতিক কাউন্সিল গঠন করা হোক। তারা মনে করছেন, সংস্কার করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আরো সম্পৃক্ততার প্রয়োজন।
বিএনপির সংস্কার প্রস্তাব
বিএনপি তাদের ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের আলোকে আলোচনা করেছে এবং ভোটে নির্বাচিত হলে এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম জানান, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো একটি সম্মিলিত আন্দোলনের অংশীদার হিসেবে এগিয়ে আসবে।
বিভিন্ন পক্ষের প্রতিক্রিয়া
আলোচনার পর বিএনপির মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দু-একজন আছেন, যারা বিপ্লব, গণ-অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট, সেটি ব্যাহত করছেন। আমরা তাঁদের সরানোর কথা বলেছি।’
হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার এবং পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের জন্য গঠিত কমিটির সাথে আলোচনা করার দাবি জানানো হয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন ছয়টি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আরও নয়টি কমিশন করার প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে আইনবিষয়ক, নাগরিক সেবাবিষয়ক এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক কমিশন অন্তর্ভুক্ত।
ভবিষ্যতের অগ্রগতি
এই সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে একটি স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। এটি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে এই সংলাপের ফলাফল এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে বলেও আশা প্রকাশ করা হচ্ছে।