সাংবাদিকতা এক অনন্য পেশা, যেখানে প্রতিদিন লাখো মানুষের গল্প তুলে আনার জন্য কাজ করেন অসংখ্য সাংবাদিক। এই কাজের পেছনে তাদের অনুপ্রেরণার উৎস কী? কীভাবে তারা বছরের পর বছর এই পেশায় নিষ্ঠার সাথে টিকে থাকেন?
সাংবাদিকতা নিয়ে ভাবলেই প্রথমত মনে হতে পারে, এই পেশা সুখের নয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয়, আবেগঘন গল্পের কাহিনীকে নির্মোহভাবে তুলে ধরতে হয় এবং অনেক সময় দীর্ঘ কাজের দিন কাটাতে হয়। তাই এক নজরে দেখলে মনে হয়, সাংবাদিকতার আনন্দ তেমন কিছু নেই।
তবুও, বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য সাংবাদিক একাগ্রতার সঙ্গে মানুষের গল্প তুলে ধরছেন। তাদের উৎসাহের উৎস কোথায়? সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে।
চিলির পন্টিফিশাল ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব ভালপারাসিসোর অধ্যাপক ড. ক্লডিয়া মেলাডো এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ফ্লোরিডার সাংবাদিকতার শিক্ষক গ্রেগরি পেরাল্টের গবেষণায় উঠে এসেছে, সাংবাদিকদের পেশায় টিকে থাকার কারণগুলোর বিস্তারিত।
গবেষকরা মূলত খুঁজে বের করেছেন, কোন বিষয়গুলি সাংবাদিকদের আনন্দিত করে। সাংবাদিকদের কাজ ছাড়ার কারণ খুঁজে বের করার চেয়ে, তাদের পেশায় টিকে থাকার উৎসাহের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্ম নিম্যানল্যাবের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের ম্যানিলাভিত্তিক প্রতিবেদক রেজিন কাবাটো বলেছেন, সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প তুলে ধরতে পারেন। এ কারণে তিনি এই পেশাকে ভালোবাসেন।
একবার তিনি কারাগারে বন্দিদের তৈরি শিল্পকর্ম নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি চান মানুষ পুনর্বাসনমূলক বিচার প্রক্রিয়ার ইতিবাচক দিকগুলো জানুক। এই প্রতিবেদনের ফলস্বরূপ, বন্দিদের আঁকা ছবির বিক্রি বেড়ে যায়। ফলে, কারাগারে থেকেও বন্দিরা তাদের পরিবারকে সাহায্য করতে সক্ষম হন।
রেজিনের মতো অসংখ্য সাংবাদিকের কাছে এই সাধারণ গল্পগুলো মানুষের জীবন বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। এমনই কিছু গল্প সাংবাদিকদের খারাপ দিনে শক্তি জোগায়।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ২০ জন সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তারা জানিয়েছেন সাংবাদিকতা করার সময় আনন্দের অভিজ্ঞতার কথা। দেখা গেছে, তারা পাঠক ও দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে মানসিক সংযোগ গড়ে তোলার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পান। এই বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে পারা তাদের কাজের মূল অনুপ্রেরণা।
এমন একজন সাংবাদিক বলেছেন, “কেউ হয়তো আমাকে তার জীবনের গল্প বলতে পারে, কারণ সে বিশ্বাস করে আমি সেটি বুঝতে পারবো এবং সঠিকভাবে অন্যদের কাছে পৌঁছে দেব।”
সাংবাদিকতার কাজের মাঝে আনন্দের উপাদান রয়েছে। সহকর্মীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক এই পেশার আনন্দকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এক ক্রীড়া সাংবাদিকের মতে, “আমাদের সম্পর্কের বন্ধনই আমাদের কাজকে আনন্দময় করে তোলে। আমরা খেলা নিয়ে তর্ক করতে পারি এবং আমাদের একটি চ্যাট গ্রুপ রয়েছে, যেখানে সব ধরনের খেলা নিয়ে আলোচনা করি।”
তাদের কাজের মাঝে রয়েছে মজাদার এবং স্মরণীয় কিছু অভিজ্ঞতা। যদিও সব গল্পই আনন্দময় নয়, তবে কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে কঠিন প্রতিবেদন তৈরিতেও আনন্দ খুঁজে নেওয়া সম্ভব।
নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিকদের জন্য ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর একটি ভয়াবহ দিন ছিল। সেদিন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার পর নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করতে তাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলা ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর কাজ, কিন্তু পেশাদারিত্বের সঙ্গে তারা সেই দায়িত্ব পালন করেন।
জেনি স্কট নামের একজন সাংবাদিক বলেন, “আমাদের এক সহকর্মী ওই হামলায় তার কাজিনকে হারিয়েছিলেন। তাকে নিজের ব্যক্তিগত দুঃখকে একপাশে রেখে পরিবারগুলোর সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল। এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারলেন, এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের কষ্টের মুখোমুখি হতে সক্ষম হয়েছেন এবং নিহতদের স্বজনদের গল্প থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।”
সাংবাদিকদের জন্য যেকোনো পরিস্থিতিতে সঠিক তথ্য তুলে ধরা এবং মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার কাজই তাদের পেশায় থাকার মূল অনুপ্রেরণা।